Header Ads

আব্রাহাম : চেলসিতে তারুণ্যের ঝাণ্ডাধারী

 




জর্জিনহোর বাতাসে ভাসানো পাসটা প্রথম দফায় নিয়ন্ত্রণে নিতে পারলেন না। ভারসাম্য হারিয়ে আরেকটু হলেই উল্টে পড়ে যাচ্ছিলেন, তবে সৌভাগ্যবশত বলের দখল কিংবা ভারসাম্য দুটো জিনিসেরই নিয়ন্ত্রণ হারালেন না। উল্ভারহ্যাম্পটনের অধিনায়ক কনোর কোডির সাথে শক্তির লড়াই করতে করতে ঢুকে পড়লেন বক্সে। এরপর হঠাৎই পায়ের বাইরের অংশের আলতো টাচে কোডিকে বোকা বানালেন, আগুয়ান গোলরক্ষক প্যাত্রিসিওর ডান পাশ দিয়ে বল জড়ালো জালে। ওয়েস্ট মিডল্যান্ডের মলিনিউ স্টেডিয়াম সেদিন অভূতপূর্ব এক ঘটনার সাক্ষী হয়েছিল, চেলসির একাডেমিতে বেড়ে ওঠা এক তরুণ নীল জার্সিতে হ্যাটট্রিক করছেন – বছর দুয়েক আগেও হয়তো কোনো “ব্লুজ” সমর্থকের কাছে ব্যাপারটা স্বপ্নের মতোই ঠেকবে। ট্যামি আব্রাহাম দেখিয়ে দিলেন কেবল দ্বিতীয় বিভাগে নয়, ইংলিশ ফুটবলের সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়মিত খেলার মতো মেধা আছে তাঁর। “অপয়া” ৯ নম্বরের জার্সির শাপমোচনও কি হলো তাতে? 

অথচ চেলসির আরো শত শত তরুণ ফুটবলারের মতোই ট্যামি আব্রাহামের জীবনটা বারবার বাক্স-পেটরা গোছানোর ছকেই বাঁধা পড়ে ছিল। ভিতেস আর্নহাইমে খেলেননি ঠিক আছে, কিন্তু মূলদলে থিতু হবার আগে তিন-তিনটে ক্লাবের হয়ে ধারে খেলেছেন। আবারো হয়তো মুসাফিরের মতো বেরিয়ে পড়তেন কিন্তু দলবদলের নিষেধাজ্ঞাটা ক্লাবের সমর্থকদের জন্য হরিষে বিষাদ হয়ে এলো। ইউরোপ আর ঘরোয়া টুর্নামেন্টে প্রতিপক্ষের উপর রীতিমতো ছড়ি ঘোরানো তরুণদেরকে শেষ পর্যন্ত চেলসির প্রথম একাদশে দেখা গেলো। তাঁদেরকে পথ দেখিয়ে এগিয়ে নেয়ার দায়িত্বটা ক্লাবের সর্বকালের সেরাদের একজন ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডের কাঁধে চাপলো। ফুটবল পণ্ডিতেরা দলের অনভিজ্ঞতা, বিশ্বমানের খেলোয়াড়ের অভাব, ল্যাম্পার্ডের সংক্ষিপ্ত কোচিং জীবনের দোহাই দিয়ে চেলসিকে পাত্তাই দিতে চাইলো না। তবে ফ্র্যাঙ্ক পেরেছেন, ফ্র্যাঙ্কের যুবারা পেরেছেন। আর মৌসুমের শেষার্ধে পড়তি ফর্ম আর আত্মবিশ্বাসের অভাবে ভোগা সত্ত্বেও ট্যামি আব্রাহামের ১৮ গোলের অবদান কোনোভাবেই অস্বীকার করার সুযোগ নেই। 
১৯৯৭ সালের ২রা অক্টোবরে দক্ষিণ লন্ডনের ক্যাম্বারওয়েলে জন্ম ট্যামি আব্রাহামের। জন্মসূত্রে ব্রিটিশ হলেও আব্রাহামের পূর্বপুরুষদের দেশ নাইজেরিয়া। ছোটবেলা থেকেই যশ-খ্যাতির সাথে পরিচয় ছিলো আব্রাহামের, স্কুলে নাটকের আয়োজন হলেই সেখানে ডাক পড়তো তাঁর। তবে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজ থেকে মাত্র ৫ মাইল দূরে যার জন্ম, ফুটবলের আহ্বান উপেক্ষা করা কী তাঁর সাজে? ট্যামি আব্রাহামও তাই চেলসির অনূর্ধ্ব-৮ দলে জায়গা করে নিলেন। আর্সেনাল দলে ভেড়াতে চেয়েছিল, কিন্তু পারেনি কারণ ট্যামি আব্রাহামের অনুপ্রেরণা উৎস যে তখন চেলসিতে। প্রিমিয়ার লিগের সেরা আফ্রিকানকে অনুশীলনে এক নজর দেখেই জীবনের লক্ষ্যটা স্থির করে ফেললো ট্যামঃ আমাকে দ্রগবা হতে হবে। এরপর একাডেমির সিঁড়ি বেয়ে তরতর করে ওপরে ওঠা। ঘরোয়া কিংবা আন্তর্জাতিক – সব ধরণের প্রতিযোগিতাতেই তখন চেলসির তরুণ যুবাদের জয়জয়কার। ২০১৪-১৫ আর ২০১৫-১৬ টানা দু’বছর এফএ ইয়ুথ কাপ আর ইউয়েফা ইয়ুথ লিগের ডাবল জিতে নিলো চেলসি, আর দুই মৌসুমে ৯৮ ম্যাচে ৭৪বার গোলের দেখা পেলেন আব্রাহাম।
 কিন্তু সেই তরুণদের দলেও আরেকজনের ছায়ায় ঢাকা পড়েছিলেন আব্রাহাম। বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনা করলে হয়তো সেটা ভেবে অবাকই লাগবে কিন্তু চেলসির একাডেমিতে ডমিনিক সোলাঙ্কিকেই সবচেয়ে বড় প্রতিভা হিসেবে বিবেচনা করা হতো। বয়সে মাত্র ১৮ দিনের বড় হলেও অর্জনের দিক দিয়ে আব্রাহামকে সবদিক দিয়েই ছাড়িয়ে গেলেন সোলাঙ্কি। ২০১৭ সালে অনূর্ধ্ব-২০ বিশ্বকাপ জিতে নিলো ইংল্যান্ডে, ৪ গোল করে প্রতিযোগিতার সেরা খেলোয়াড়ের পুরষ্কার বাগিয়ে নিলেন সোলাঙ্কি। অথচ চেলসির বয়সভিত্তিক দলে তাঁর স্ট্রাইকিং পার্টনার আব্রাহাম ২৩ জনের স্কোয়াডেই সুযোগ পেলেন না। ২০১৫ সালের সেপ্টেম্বরে চ্যাম্পিয়ন্স লিগে মারিবরের বিপক্ষে মূলদলে অভিষেকও হয়ে গেলো সোলাঙ্কির, আব্রাহাম তখনো পর্যন্ত চেলসির কাছ থেকে পেশাদার চুক্তির প্রস্তাব পাননি। তবে এরপরই পাশার দান উল্টে গেলো - আব্রাহাম এখন চেলসির একাদশে জায়গা করে নেবার জন্য জিরু-ভের্নারের সাথে লড়ছেন, আর সোলাঙ্কি? তিনি ধুঁকছেন দ্বিতীয় বিভাগে। অনেক আশা নিয়ে ১৯ মিলিয়ন পাউন্ড খরচা করে তাঁকে দলে ভিড়িয়েছিলেন এডি হাউ, ৪২ ম্যাচে ৩ গোল করে সেই পাহাড়সম প্রত্যাশার ভগ্নাংশটুকুও পূরণ করতে পারেননি সোলাঙ্কি। প্রিমিয়ার লিগে সবমিলিয়ে ৬৩ ম্যাচে ৪ গোল সোলাঙ্কির, ৬৫ ম্যাচে ইতোমধ্যেই ২০ গোলের মাইলফলক পেরিয়ে গেছেন আব্রাহাম। সূর্যোদয় আসলে সবসময় দিনের পূর্বাভাস দেয় না। 
২০১৬ সালে অন্তর্বর্তীকালীন কোচ গুস হিডিঙ্কের অধীনে অভিষেকের পর আব্রাহামের ক্যারিয়ারের গতিপথ আর দশজন একাডেমি গ্র্যাজুয়েটের চেয়ে ভিন্ন কিছু ছিল না। ২০১৬-১৭ মৌসুমে দ্বিতীয় বিভাগের দল ব্রিস্টল সিটির হয়ে ধারে খেলতে গেলেন আব্রাহাম। সুযোগটা হেলায় হারাতে রাজি ছিলেন না দীর্ঘদেহী ফরোয়ার্ড, লিগে ২৩ গোলসহ সবমিলিয়ে ২৬ বার বল জালে জড়ালেন। সেই মৌসুমে চ্যাম্পিয়নশিপে এর চেয়ে বেশি গোল করেছিলেন মাত্র একজন (ক্রিস উডঃ লীডস, ২৭ গোল), ট্যামির ফর্ম ব্রিস্টলকে (১৭তম স্থান) চ্যাম্পিয়নশিপে টিকিয়ে রাখলো। ট্যামির গোলের বন্যা দেখে সদ্য প্রমোশন পাওয়া দল নিউক্যাসল ধারে নিতে চাইলো তাঁকে। কিন্তু উদ্দাম নৈশ জীবনের কুখ্যাতি(না সুখ্যাতি) বিবেচনা করে টাইনসাইডে পাড়ি জমাতে চাইছিলেন না আব্রাহাম, তাঁর সমস্ত সত্ত্বাজুড়ে তখন ফুটবল। 
তাই ধারে খেলতে আবার পশ্চিমে রওনা হলেন তিনি, এবার গন্তব্য দক্ষিণ ওয়েলসের ক্লাব সোয়ানসি। কিন্তু সোয়ানসিতে তখন কান পাতলেই শোনা যাচ্ছিল বেলাশেষের করুণ সুর। প্রিমিয়ার লিগের প্রথম স্বাদটা আব্রাহামের মুখে বড্ড তেতো লাগার কথা, ৩১ ম্যাচ খেলে মাত্র ৫ গোল পেলেন তিনি। সর্বসাকল্যে ৩৩ পয়েন্ট জোগাড় করা সোয়ানসির শেষটা দেখে ফেললো প্রিমিয়ার লিগ, ট্যামি আব্রাহামের শেষটাও কি? ফর্ম ফিরে পেতে আবার চ্যাম্পিয়নশিপের শরণ নিলেন তিনি, এবার প্রমোশনপ্রত্যাশী সাবেক ইউরোপসেরা অ্যাস্টন ভিলার মেরুন জার্সিতে গায়ে চাপালেন নাইজেরিয়ান বংশোদ্ভূত এই স্ট্রাইকার। দ্বিতীয় বিভাগে ফিরেই ফের নিজের জাতটা চেনালেন ট্যামি, এবার তার ২৫ গোলে চেপে প্লে-অফের বাধা পেরিয়ে তিন বছরের মধ্যেই প্রথম বিভাগে ফিরে এলো বার্মিহামের ক্লাবটি। কিন্তু চেলসিতে যে তারুণ্যের মূল্য দেয়া হয় না, এবার কী করবেন আব্রাহাম?
দলবদলের নিষেধাজ্ঞার এক ঝড়েই নিজেদের চিরচেনা রূপ পাল্টে ফেললো চেলসি। জোড়াতালি দেয়া স্কোয়াডের সাথে একাডেমি থেকে উঠে আসা একঝাঁক তরুণকে সামনে এগিয়ে নিতে গুরু হিসেবে নিয়ে আসা হলো ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডকে। শুরুটা জঘন্য হলো, ম্যানচেস্টার ইউনাইটেডের মাঠে থেকে ৪-০ গোলে হেরে মৌসুম শুরু হলো “সুপার” ফ্র্যাঙ্কের। সেই ম্যাচে একবার পোস্টে বল মেরেছিলেন আব্রাহাম, আক্রমণে ধার থাকলেও ভঙ্গুর রক্ষণের মাশুল দিতে হয়েছিল চেলসিকে। তবে এর চারদিন পরে নীল জার্সিতে আব্রাহামের সবচেয়ে খারাপ দিনটা এলো। ইউরোপসেরা হওয়া লিভারপুলের বিপক্ষে দারুণ যুঝে ম্যাচটাকে পেনাল্টি পর্যন্ত টেনে নিয়েছিলো ল্যাম্পার্ডের শিষ্যরা। শ্যুট-আউটে প্রথম ৯ জন জাল খুঁজে পেলেও গোলের মাঝ বরাবর মারা আব্রাহামের পেনাল্টি ঠেকিয়ে দিলেন আদ্রিয়ান। কান্নায় ভেঙ্গে পড়া আব্রাহামকে সান্ত্বনা দিতে এগিয়ে এলেন সতীর্থরা, কিন্তু “শাস্তি”র শেষ হয়নি তখনো। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আব্রাহামকে অকথ্য ভাষায় গালাগাল করা হলো, তিনি যে একজন ফুটবলার সর্বোপরি একজন মানুষ সেটা ভুলে গিয়ে কিছু তথাকথিত চেলসি “সমর্থক”-এর কাছে তাঁর চামড়ার রংটা বড় হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এমন মন্তব্য দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়লেন আব্রাহামের মা, তবে আব্রাহামের নিজের চোয়ালবদ্ধ প্রতিজ্ঞা আরো দৃঢ় হলো তাতে। এক ম্যাচ বাদেই চেলসির জার্সি গায়ে নিজের প্রথম গোল পেয়ে গেলেন। ম্যাচের তৃতীয় মিনিটে ডানপাশ থেকে উড়ে আসা আযপিলিকুয়েতার ক্রসে “ফার্স্টটাইম” হাফভলি করে জালে পাঠিয়ে দিলেন। পরে জয়সূচক গোলও এলো তাঁর পা থেকে। পরের ম্যাচে শেফিল্ডের সাথে জোড়া গোল, এরপর উলভসের বিপক্ষে সেই হ্যাটট্রিক। তিন ম্যাচে ৭ গোল, আব্রাহাম রীতিমতো উড়ছেন। চ্যাম্পিয়ন্স লিগে লিলের বিপক্ষে গোল পেলেন, মোটামুটি বিরতি দিয়ে লিগেও গোল করে যাচ্ছিলেন। একটা গোলের অবশ্য আব্রাহামের মনে বিশেষ জায়গা করে নেয়ার কথা। ডিসেম্বরে এমিরেটসে তাঁর ৮৭ মিনিটের গোলেই সেদিন ৩ পয়েন্ট তুলে নিয়েছিলো চেলসি। গোলের পর “ফিস্ট পাম্প” উদযাপনে আর্সেনালের নিয়মিত হন্তারক দ্রগবাকে মনে করিয়ে দিয়েছিলেন সেদিন। “৯ নম্বর” জার্সির অভিশাপ এবার বুঝি দূর হলো।
তবে শাপমোচন হয়নি, বছর ঘোরার পর চোট সমস্যা আর ফর্মহীনতায় ল্যাম্পার্ডের প্রথম পছন্দ হয়ে গেলেন জিরু। চোট কাটিয়ে ফিরিয়ে আসার পরও আত্মবিশ্বাসের অভাবটা স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। সহজ সুযোগ মিস করলেন, শরীরের ভারসাম্যটাও কেমন যেন নড়বড়ে লাগছিল। পেশাদার ফুটবল বড় নিষ্ঠুর, আর বড় ক্লাবে সেটা নিষ্ঠুরতর। মৌসুমের শুরুর দিকে আব্রাহামের অবদানটা ভুলে গেলো অনেকেই, একের পর এক সমালোচনার তিরে বিদ্ধ হতে থাকলেন আব্রাহাম। টিমো ভের্নারের আগমনে একাদশে সুযোগ না পাওয়ার সম্ভাবনাটা বেড়ে গেছে বহুগুণ। দামী খেলোয়াড়দের একাদশে রাখার জন্য ল্যাম্পার্ডের ওপর চাপ থাকবে, আগের মতো তারুণ্যকে বিশ্বাস করতে পারবেন ইংলিশ কিংবদন্তী? টিমো ভের্নারের পাশে নিজেকে মানিয়ে নেয়ার সুযোগ পাবেন ট্যামি আব্রাহাম? নাকিই বেঞ্চে বসেই দিনগুজরান করতে হবে। চেলসি সমর্থকেরা অবশ্য এখনো নিজেদের আঙ্গিনায় বেড়ে ওঠা তরুণদের ওপর আস্থা হারাচ্ছেন না। তাদের বিশ্বাস, সামনের মৌসুমেও আরো অনেকবার উৎসবের উপলক্ষ এনে দেবেন ইংল্যান্ড জাতীয় দলের স্ট্রাইকার। নরফোকের সেই দুপুরবেলার উল্লাসটা বারবার ফিরে আসুক। “৯ নম্বর” জার্সি পড়া চেলসির ঘরের ছেলে নিজের প্রথম গোলের পর ছুটে গিয়ে ক্লাবের জীবন্ত কিংবদন্তীকে জড়িয়ে ধরছেন – ছবিটা নিঃসন্দেহে বাঁধিয়ে রাখার মতো। চেলসি ফুটবল ক্লাবের সমর্থক হিসেবে এর চেয়ে বেশি কিছু চাওয়ার আছে?         
    
- সাবিত হক

2 comments:

Powered by Blogger.