২০২০ সালের ১২ই জানুয়ারি। ঘরের মাঠে বার্নলির বিপক্ষে ২-০ গোলে এগিয়ে চেলসি। ফুটবলীয় অনিশ্চয়তা আর মৌসুমে চেলসির রক্ষণের খামখেয়ালিটুকু বাদ দিলে তিন পয়েন্টই তুলে নিতে যাচ্ছে “ব্লু”রা। ম্যাচের ৪৯ তম মিনিটে বার্নলি বক্সের বাঁ-প্রান্তে বল পেলেন মেসন মাউন্ট। পায়ের আলতো ছোঁয়ায় সেটি অধিনায়ক আযপিলিকুয়েতাকে দিয়ে দিলেন। এক টাচে বল নিয়ন্ত্রণ নিয়ে ঘাড় তুলে বক্সের ভেতরের গতিবিধি দেখে নিলেন “ডেভ”। অনুমিতভাবেই ক্রস উড়ে এলো। ডোয়াইট ম্যাকনিল বলের দিকে এগিয়ে এলেও খেয়াল করেননি তাঁর ব্লাইন্ডসাইডে একজন চেলসি খেলোয়াড় রান নিয়েছে। ছ’গজি বক্সের মধ্যে স্লাইডিং হাফ ভলিতে নিক পোপকে পরাস্ত করলেন ক্যালাম হাডসন-অডয়। উদযাপনে উল্লাস থেকে থেকে স্বস্তিটাই বেশি চোখে পড়ছিল। ইংল্যান্ডের প্রথম বিভাগে প্রথম গোল, তাও সেটা অভিষেকের বছর দুই পরে। এখন পর্যন্ত সেটাই হাডসন-অডয়ের ক্যারিয়ারে একমাত্র লিগ গোল হয়ে আছে। প্রতিভা আছে, মাঠেও সেটার প্রতিফলন দেখা গেছে নিয়মিতই। তবে মাঠের বাইরের বিতর্ক যেন পিছু ছাড়ছে না তরুণ ইংলিশের। সবকিছু ভুলিয়ে দিতে মাঠের পারফরমেন্সের চেয়ে বড় টোটকা নেই, “চো”কে তাই ঘাসের ১২০ গজেই দারুণ কিছু করে দেখাতে হবে।
• ২০০০ সালের নভেম্বরে ৭ তারিখে বিসমার্ক অডয়ের দ্বিতীয় সন্তান প্রথমবারের মতো এই ধরাধমের আলো দেখলো। দেশে থেকে বিসমার্ক সাহেব নিজেও ফুটবলার ছিলেন, তবে ইংল্যান্ডে পাড়ি জমানোর পর আর মাঠে নামা হয়নি। ঘানাইয়ান বংশোদ্ভূত ক্যালামের রক্তে ফুটবল তাই ভালোমতোই মিশে ছিল। বল নিয়ে মাঠে দৌড়ে বেড়ানোর চেয়ে ক্ষুদে ক্যালামের অবশ্য “জাগলিং” আর ট্রিকসই পছন্দ ছিল বেশি। ক্যালামের জন্মস্থান ওয়ান্ডসওয়ার্থ থেকে স্ট্যামফোর্ড ব্রিজের দূরত্ব দু’মাইলেরও কম, চেলসির স্কাউটদের তাই সাত বছর বয়সী ক্যালামকে নিজেদের করে নিতে দু’বার ভাবতে হয়নি। বলের কারিকুরিতে সমবয়সীদের চেয়ে যোজন যোজন এগিয়ে ছিলো ক্যালাম, কিন্তু ফুটবলীয় মেধাবিকাশের ক্ষেত্রে সেটাই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছিলো। অনুশীলন, ইন্ডোর কিংবা ফুটসালে হয়তো “শো-বোটিং” মানায়, তবে ফুটবলের মাঠে কারিকুরি দেখানোর জন্য সতীর্থকে বল পাস দেওয়াটাই বেশি দরকার হয়ে পড়ে। নইলে মেসি-রোনালদোরা নন, কোনো ফ্রি-স্টাইলারাই ফুটবলের সবচেয়ে বড় তারকা হতেন। দেরিতে হলেও নিজের সহজাত প্রবৃত্তিকে দমন করতে পেরেছিল ক্যালাম। ফলাফল? চেলসির বয়সভিত্তিক দলগুলোতে একের পর এক তাক লাগানো পারফরমেন্স। একহারা গড়নের প্রধান অস্ত্র ছিল গতি আর সেই কারিকুরি। এর সাথে ফিনিশিং দক্ষতার মিশেলে এক পরিপূর্ণ ফুটবলার হবার পথেই ছিলেন হাডসন-অডয়।
• একাডেমিতে সাধারণত নিজের বয়সের চেয়ে এক-দুই বছরের বড়দের সাথে ফুটবল খেলতেন হাডসন-অডয়। কোবহামের অন্দরমহলে তাঁর নাম ছড়িয়ে পড়লেও বাইরে খুব একটা পরিচিত ছিলেন। বিশ্বমঞ্চে নিজেকে তুলে ধরার সুযোগ এলো ২০১৭ সালের অনূর্ধ্ব-১৭ বিশ্বকাপ মঞ্চে। ভারতের মাটিতে পা দেয়া স্টিভ কুপারের স্কোয়াডে চেলসির একাডেমি থেকে ছিলেন পাঁচজন, তবে ম্যাকেকরান, গাহি, পানযো কিংবা গ্যালাঘারের চেয়ে পাদপ্রদীপের আলোটা হাডসন-অডয়ের দিকেই। গ্রুপপর্বে ক্লাব বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের ডাক জেডোন সাঞ্চো স্কোয়াড থেকে সরে দাঁড়ানোয় বা-উইংটাকে নিজের করে নিলেন হাডসন-অডয়। অনায়াসে গ্রুপপর্বের বৈতরণী পেরিয়ে গেলেও আরেকটু হলেই শেষ ষোলোতে জাপানের বিপক্ষে ট্রাইবেকারের শরণ নিতে হয়েছিল ইংরেজ যুবাদের। এরপর কোয়ার্টার ফাইনাল ও সেমিফাইনালে যথাক্রমে যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রাজিলের বিপক্ষে টানা দুই হ্যাট্ট্রিক করে বসলেন ছয় বছর চেলসির একাডেমিতে কাটানো রিয়ান ব্রুস্টার। সল্ট লেক স্টেডিয়ামের ফাইনালে অবশ্য আধঘণ্টা পেরোতে না পেরোতেই ইংরেজ শিবিরের মুখগুলো থেকে হাসি উবে গিয়েছিল। সার্জি গোমেজের জোড়া গোলে শিরোপাস্বপ্ন তখন দূর আকাশে মিলিয়ে যাওয়ার জোগাড়। অবশ্য ম্যাচে খুব ভালোভাবেই ফিরেছিল ইংল্যান্ড - ব্রুস্টার, গিবস সমতা ফেরানোর পর হাডসন-অডয়ের পাসে ইংল্যান্ডকে এগিয়ে দিলেন ফোডেন। এরপর গাহি ব্যবধান বাড়ানোর পর ৮৮ মিনিটে স্প্যানিশ কফিনে শেষ পেরেক ঠোকার কাজটা করলেন ফোডেন, অ্যাসিস্ট আবার সেই ক্যালামের। বিশ্বসেরা হলো ইংল্যান্ড, পুরো টুর্নামেন্টজুড়ে ভালো খেলা ক্যালাম হাডসন-অডয় তাঁর জাত চেনালেন ফাইনালে এসে।
• আন্তোনিও কন্তে সবই দেখছিলেন, তাই নীল জার্সি গায়ে মাঠে নামতে আর মাত্র ছ’মাস অপেক্ষা করতে হলো ক্যালামকে। ২০১৮ সালের ২৮ জানুয়ারি নিউক্যাসলের বিপক্ষে এফএ কাপে অভিষেক হলো হাডসন-অডয়ের। প্রথম মৌসুমে সবমিলিয়ে মাঠে নামতে পারলেন তিনবার – বদলি হিসেবে। মৌসুমশেষে অনেক তিক্ততা নিয়ে কন্তে বিদায় নিলে তাঁর স্থলাভিষিক্ত হলেন আরেক ইতালিয়ান মরিসিও সারি। কমিউনিটি শিল্ডে ম্যানচেস্টার সিটির বিপক্ষে প্রথমবারের মতো একাদশে সুযোগ পেলেন, তেমন কিছু করতে পারলেন না, ম্যাচটা ২-০ গোলে হেরে গেলো চেলসি। নভেম্বরে ইউরোপা লিগে পাওকের বিপক্ষে প্রথম গোল পাওয়ার পর থেকে হাডসন-অডয়ের আত্মবিশ্বাস বেড়েই চলছিল। আক্রমণের ডান প্রান্তে ডিফেন্ডারদেরকে যেমন শশব্যস্ত করে রাখছিলেন, তেমনি দারুণ সব ক্রসে গোলের সুযোগ তৈরি করে দিচ্ছিলেন। এফএ কাপের তৃতীয় রাউন্ডে নটিংহাম ফরেস্টের বিপক্ষে প্রথম গোল করলেন, এরপর মোরাতাকে দিয়ে জোড়া গোল করালেন। আচমকা দৃশ্যপটে হাজির বায়ার্ন মিউনিখ, বায়ার্নের ক্রীড়া পরিচালক হাসান সালিহামিদজিচ প্রকাশ্যেই হাডসন-অডয়ের প্রশংসা করলেন, জার্মানিতে যাওয়ার জন্য ক্যালাম নিজেও উদগ্রীব হয়ে ছিলেন। চেলসি বোর্ড অবশ্য তাঁকে রেখে দিলো, কে জানে তারপর থেকেই হয়তো তাঁর পারফর্মেন্সে ঘাটতি চোখে পড়ছে। যদিও বাকি মৌসুমটাতেও আলোর ছটা ছড়াচ্ছিলেন। ব্রাইটনের বিপক্ষে ম্যাচে সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে লিগ স্টার্টে অ্যাসিস্ট দাতা হিসেবে রেকর্ডবুকে নাম লেখালেন। এপ্রিলে বার্নলির বিপক্ষে ম্যাচে একিলিস টেন্ডনের চোটে মৌসুম শেষ হয়ে গেলো। ২৯ ম্যাচে মাঠে নেমে ছয় গোল আর সাত অ্যাসিস্ট – ১৮ বছর বয়সী কারো জন্য রেকর্ডটা দারুণই বলতে হবে। পরের মৌসুমটা ভালো কাটেনি। চার গোল, সাত অ্যাসিস্টের চেয়ে মাঠের বাইরে নানা বিতর্কে জড়ানোটাই মৌসুমের “হাইলাইট” হয়ে থাকলো। অনেক চেলসি সমর্থক তো এখনই ক্যালাম হাডসন-অডয়কে বাতিলের খাতায় ফেলে দিয়েছেন। অবশ্য কাঁচা বয়সের জন্য কেউ কেউ আস্থা রাখছেন তাঁর উপর, ফ্র্যাঙ্ক ল্যাম্পার্ডও বারবার তাঁকে আগলে রেখেছেন। তবে শুধু প্রতিভা নয়, শীর্ষ পর্যায়ে সফল হতে হলে আত্মনিবেদন, পরিশ্রম আর ধারাবাহিকতা লাগে। এই মৌসুমেও চোট সমস্যায় ভোগার পর নতুন কোচ টুকলের শেষমেশ দারুণ কিছু করার আভাস দিচ্ছেন।
চেলসিতে ওরা নাকি তরুণদের স্বপ্ন গলা টিপে মারে। মাউন্ট, আব্রাহাম, হাডসন-অডয়, জেমসদের আগেও বহু সম্ভাবনায় কিশোরের পদচারণায় মুখরিত হয়েছে চেলসির একাডেমি। কিন্তু তাৎক্ষণিক সাফল্য অর্জনের চাপে পিষ্ট হয়েছে তাঁদের স্বপ্নগুলো। তবে মানুষ তো আশায়ই বাঁচে, নাকি? দুনিয়াজোড়া লাখো চেলসি ভক্তের একটাই চাওয়া, ঘরের ছেলেগুলো যেন ক্লাবেই থাকে। বাস্তবতার ছুরিটা এসে সব ফালাফালা দেবার আগপর্যন্ত আমরা স্বপ্ন বুনতে থাকি। সমর্থকেরা তবুও আশা রাখতেই পারে। করোনার প্রকোপ কমে এসে একদিন স্ট্যামফোর্ড কানায় কানায় ভরে উঠবে। দারুণ এক হ্যাটট্রিক করে হয়তো গ্যালারির দিকে ছুটে যাবেন হাডসন-ওডয়। টাচলাইনের বাইরে আনন্দের আতিশায্যে স্বপ্নের আবেশ আঁকা বলবয়টাকে জড়িয়ে ধরবেন ক্যালাম। ঠিক যেভাবে স্যামুয়েল এতো একদিন জড়িয়ে ধরেছিলেন তাঁর হাত।
© সাবিত হক
No comments